হিমালয়ান সল্ট বা গোলাপি লবণের কথা অনেকেই শুনে থাকবেন বা চিনে থাকবেন। অনেকে আবার এই লবণকে রক সল্ট বা সৈন্ধব লবণ বা পিংক সল্ট নামেও চিনে থাকে।
এটি ভারত থেকে চীনে যে প্রসারিত পর্বতশ্রেণি রয়েছে,তার মধ্যে পাওয়া যায়। এর মধ্যে হিমালয় পর্বত হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত। এই পর্বতেরশ্রেণি থেকে এই লবণের দেখা পাওয়া যায়

বলে একে হিমালয়ান সল্ট বলা হয়।
এটি গোলাপি দেখায় কারন এতে সাদা,লাল ও গোলাপি রঙের খনিজ পদার্থ রয়েছে।সাধারণ লবণের থেকে পুষ্টিগুণে এগিয়ে এই লবণটি।
অনেক রোগ থেকে মুক্তি দেয় এই লবণ। এবার জেনে নিই কিভাবে এই লবণ খেতে হবে এবং এই লবণের উপকারিতা।
পিংক বা সৈন্ধব বা রক সল্ট পৃথিবীতে পাওয়া সবথেকে বেশি
খাঁটি লবণ।যা দূষিত ও বিষাক্ত পদার্থমুক্ত। এটি হিমালয় পর্বত থেকে উৎপন্ন হয় এবং সেখানে এই লবণ সাদা সোনা
বা হোয়াইট গোল্ড নামেও পরিচিত।গোলাপি বর্ণের জন্য এই
লবণটি অন্যান্য লবণ থেকে ব্যতিক্রম।

যা আয়রন অক্সাইডের উপস্থিতির কারনে হয়ে থাকে।
১. এই লবণ প্রধানত সোডিয়াম ক্লোরাইড দিয়ে গঠিত।তবে এতে সালফেট,ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম,পটাশিয়াম,ফসফরাস,জিংক,কপার,সেলুনিয়ামসহ প্রায় ৮০ টি উপাদান থাকে।এই লবণে খনিজ উপাদানগুলো আঠালো গঠনে থাকে।মানুষের দেহকোষে তাই সহজে শোষিত হতে পারে।
২. খনিজ লবণে সমৃদ্ধ এই লবণ দেহ ও মনের নিরাময়ে বিস্ময়করভাবে কাজ করে।হিমালয়ান পিংক সল্টে বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রোলাইট থাকে।যা দেহের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে।দেহের কোষগুলোর কাজ সঠিকভাবে
সম্পূর্ণ হবার জন্য দেহের আর্দ্রতা বজায় থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।এই লবণে উপস্থিত প্রধান ইলেকট্রোলাইটগুলো হচ্ছে সোডিয়াম,পটাশিয়াম,ক্যালসিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্লোরাইড।এই ইলেকট্রোলাইটগুলো পানির চেয়ে ও খুব দ্রুত দেহে শোষিত হয়।
৩. একটি কাচের জারে এক ইঞ্চি পরিমাণ ক্রিস্টাল হিমালয়ান সল্ট নিন,এর মধ্যে দুই থেকে তিন ইঞ্চি
পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে সারারাত।সকালে এই দ্রবণটি থেকে এক চা চামচ দ্রবণ নিয়ে একগ্লাস
পানিতে মিশিয়ে পান করতে হবে।তবে এই দ্রবণ তৈরির সময়
ধাতব চামচ বা ধাতব ঢাকনা ব্যবহার করা যাবেনা।এভাবে এই নিয়মে এই লবণমিশ্রিত পানি খেতে পারলে দেহের তরলের ভারসাম্য রক্ষা হবে।
৪. দেহকে বিষমুক্ত হতে সাহায্য করে হিমালয়ান পিংক সল্ট।

৫. এই লবণ গোসলের পানিতে ব্যবহার করলে দেহের কোষগুলো পুনরুজ্জীবিত এবং বিষমুক্ত হয়।এই লবণের খনিজ উপাদানগুলো পানিতে স্থানান্তরিত হয়।তাই যখন এই
পানি দিয়ে গোসল করা হয় তখন দেহের কোষ ও রক্তস্রোত থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায়।ফলে দেহ সহজেই বিষমুক্ত হয়।
৬. পরিপাক নালীকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে এই রক
সল্ট বা হিমালয়ান সল্ট।এটি জোলাপ হিসেবে কাজ করে।আর পরিপাকতন্ত্রের জমে থাকা টক্সিনকে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে বের হতে সাহায্য করে।এই লবণ দেহে pH এর ভারসাম্য রক্ষা করে।এই লবণ দেহের ক্ষারীয় অবস্থা বজায়
রাখতে সাহায্য করে।

৭. হিমালয়ান পিংক সল্ট দেহের তরলের হাইড্রোজেন আয়নের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
৮. সীসা,মার্কারি ও আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতু শরীর থেকে বের করতে সাহায্য করে।
৯. শ্বাসতন্ত্রের রোগ থেকে মুক্তি দেয় এই পিংক সল্ট বা
হিমালয়ান সল্ট।সাইনোসাইটিস এ্যাজমা ও এলার্জি থেকে
নিরাময়ে সাহায্য করে এই লবণ।শ্বসনতন্ত্রকে পরিষ্কার হতে
এবং ক্ষতিকারক পদার্থকে বের হতে সাহায্য করে।এই লবণের এন্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান অতিরিক্ত মিউকাসকে নরম ও আলগা হতে সাহায্য করে।
১০. এই লবণের উপাদানগুলো ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুকে নিরাময়ে সাহায্য করে।গরম পানিতে
পিংক সল্ট দিয়ে এর ভাঁপ নিতে পারেন।
১১. পিংক সল্ট বা সৈন্ধব লবণ দাঁতের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।ব্লাড সুগার স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে এই লবণ।
১২. পেশী সংকোচন প্রতিরোধ করে।ত্বকের প্রদাহ দূর করতে সাহায্য করে।
১৩. ভালো ঘুম হবার জন্য এই লবণ খাওয়া খুব উপকারী।
১৪. ত্বকে চুলকানি বা একজিমার সমস্যা হলে ভাঁপ নিতে
পারেন এই লবণ গরম পানিতে মিশিয়ে। এই লবণ ত্বকের লোমকূপগুলোকে খুলে দেয়।রক্ত সঞ্চালন ভালো করে এবং ত্বকের টিস্যুগুলোকে হাইড্রেট করে।
১৫. রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এই
লবণ।এতে রক্তচাপ কমে এবং ভালো থাকে হার্ট। এতে হার্ট
এটাকের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
১৬. ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এই লবণ উপকারী।
১৭. পিংক সল্ট শরীরে দুটি হরমোন ক্ষরণ করে।যা অবসাদ ও দুশ্চিন্তা কাটাতে সাহায্য করে।
১৮. পেশী সুস্থ রাখার পাশাপাশি পেশীতে ব্যথা ও টান ধরা
কমায় এই লবণ।কারন পেশীকে সুস্থ রাখতে যে পটাশিয়ামের
দরকার তা এই লবণে পর্যাপ্ত বিদ্যমান।
১৯. এই লবণ মুখের দুর্গন্ধ দূর করে এবং যৌনশক্তি বাড়ায়।
২০. ওজন কমাতে এই লবণ দারুণ কার্যকরী।যারা কিটো
ডায়েট করে তারা সবসময় এই লবণ খেয়ে থাকেন।
প্রতিদিন যেকোন খাবারে এই লবণ ব্যবহার করা যায়।এটি খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে।ফুড,ভেজিটেবল স্যালাদ,শরবতেও মিশিয়ে খাওয়া যায়।
একগ্লাস পানিতে দুই চা চামচ পিংক সল্ট,দুই চামচ লেবুর রসও আধা চা চামচ লেবুর খোসা কুড়িয়ে মিক্স করে খেয়ে নিন।দেখবেন নিমেষে মাইগ্রেনের যন্ত্রণার উপশম হবে।
একগ্লাস পানিতে আদার রস ও পিংক সল্ট মিশিয়ে খেলে দ্রুত ওজন কমানো সম্ভব।
মাংসপেশিকে সুস্থ রাখতে গোসলের হালকা গরম পানিতে এই লবণ মিশিয়ে নিন।দেখবেন এতে আপনি অনেকটাই উপকার পাচ্ছেন।

☆☆হিমালয়ান পিংক সল্ট কেন এতো দামি
লবণ ছাড়া রান্না চিন্তাই করা যায় না।রন্ধনশিল্পে ব্যবহৃত সর্বাধিক প্রয়োজনীয় একটি সামগ্রী,যা মূলত সোডিয়াম ক্লোরাইডসমৃদ্ধ।সমুদ্রের পানিকে শুকিয়ে লবণ প্রস্তুত করা হয়,যা
সামুদ্রিক লবণ নামে পরিচিত।
এছাড়া পৃথিবীর বেশকিছু অঞ্চলে মাটির নিচে শিলা অবস্থায় ও লবণ পাওয়া যায়।যাকে রক সল্ট বলা হয়।হিমালয়ান পিংক সল্ট তেমনি একটি
রক সল্ট।হিমালয়ের পাদদেশে মাইনিং করে এই লবণ পাওয়া যায়।এই লবণে সোডিয়াম ক্লোরাইড,পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম,ক্যালসিয়াম থাকে।
এই লবণে ৮৪ টি প্রাকৃতিক
মিনারেলস থাকে।তাই মানবদেহের জন্য এই পিংক সল্ট অধিক পুষ্টিকর।
বিশ্বে ১০০গ্রাম এই লবণের মূল্য ৫-৮ ডলার।অর্থাৎ এককেজি পিংক সল্টের দাম ব্যাণ্ডভেদে ৫০-৮০ ডলার হয়ে থাকে।রান্নাবান্না,ঘর সাজানো,রূপচর্চাসহ বিভিন্ন কাজে এই লবণের ব্যবহার রয়েছে।যে কারনে ২০২৫ সালের মধ্যে পিংক সল্টের বিশ্ববাজারে মূল্য ১৩ ডলার হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
রক সল্ট মূলত কয়েক হাজার বছর আগে শুকিয়ে যাওয়া
সমুদ্রের পানি,যা দীর্ঘ সময় ধরে ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে মাটির গভীরে চাপা পড়ে যাওয়ায় শিলা অবস্থা ধারণ
করে।
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় মাটির হাজারো ফিট গভীরে
রক সল্ট পাওয়া যায়।পরে তা মাইনিং এর মাধ্যমে উত্তোলন করে,প্রক্রিয়াজাত করে খাবার উপযোগী করা হয়।সব রক সল্টই আসলে সামুদ্রিক লবণ।পাকিস্থানের পাঞ্জাব প্রদেশের বতর্মান খেওরাতে এই লবণের সন্ধান পাওয়া যায়।
মূলত পাকিস্তানের হিমালয়া পথহর মালভূমির দক্ষিণ প্রান্তে প্রায়
৩০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সল্ট রেঞ্জ এর ৬ টি খনি থেকে পিংক সল্ট মাইনিং করা হয়।খেওরা সল্ট মাইন প্রায় ৭৪৮ ফিট গভীর এবং এতে ৬.৭বিলিয়ন টন লবণ রয়েছে।বিশ্বের সবচেয়ে বড় পিংক সল্ট প্রস্তুতকারক হয়েও রপ্তানির দিক থেকে পাকিস্তানের অবস্থান বিশতম।যেখানে প্রতিবেশী
রাষ্ট্র ভারত ও চায়না যথাক্রমে সপ্তম ও নবম স্থানে রয়েছে।
কারন পাকিস্তান মাইন করে উত্তোলন করা লবণ খাবার উপযোগী না করেই শুধুমাত্র শিলা অবস্থায় রপ্তানি করে থাকে।পাকিস্থান প্রতিবছর ৪ লক্ষ টন পিংক সল্ট রপ্তানি করে থাকে।বাংলাদেশে সাধারণ খাবার লবণ কেজি প্রতি ৩৫-৪০
টাকা।আর ১০০ গ্রাম হিমালয়ান পিংক সল্টের দাম ২০০-২৫০ টাকা পযর্ন্ত হয়ে থাকে।হিসেব করলে যা কেজি হিসেবে ২০০০-২৫০০ টাকা।কিন্তু কেন পিংক হিমালয়া সল্টের দাম এতো বেশি?
যেহেতু পিংক সল্টের খনি একমাত্র পাকিস্তানের পাঞ্জাব রেঞ্জে অবস্থিত,তাই এটি বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দুষ্প্রাপ্য।পাকিস্তান এই লবণ উত্তোলনের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেনা,তাই পিংক সল্ট মাইনিং বেশ শারীরিক পরিশ্রম নির্ভর একটি কাজ।তাই এই কাজ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও
সময়সাপেক্ষ ও বটে।তাই হিমালয়ান পিংক সল্টও খুব ব্যয়বহুল।যেহেতু পিংক হিমালয়ান সল্টের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে,কিন্তু খনির স্বল্পতা ও অনুন্নত উত্তোলন ব্যবস্থার কারনে হিমালয়ান সল্টের উৎপাদন খুব সীমিত।

যেহেতু এটি
একটি প্রাকৃতিক খনিজ,তাই চাইলেও এর উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব নয়।পাকিস্তান খনি থেকে তুলে শিলা অবস্থায় বিভিন্ন দেশে এই লবণ স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে দেয়।সেসব দেশ পরবর্তীতে ব্যয়বহুল প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে এই পিংক সল্টকে খাবার উপযোগী করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী
রপ্তানি করে।যার ফলে পিংক হিমালয়ান সল্টের মূল্য আরো বেড়ে যায়।যদি পাকিস্তান প্রসেসিং করে এই সল্ট বিক্রি করতো তবে দাম অনেক কম থাকতো।
0 Comments