পাম গাছ,যা কিনা বিভিন্ন ভেষজ উপকারে আসা সহ পাম তেল তৈরির প্রধান উপাদান। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এর চাষ হলেও বর্তমানে এশিয়া জুড়ে এর চাষাবাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
পাম গাছ হচ্ছে একপ্রকার ফলজ উদ্ভিদ।যা দেখতে অনেকটাই খেজুর গাছের মতো।এর ফলগুলো দূর থেকে দেখলে খেজুর বলে ভুল হয়।
রোপণের প্রায় তিন বছরের মাথায় ফল দেওয়া শুরু করে।আর একমাসে একটা গাছ থেকে খরচ বাদ দিয়ে এক দেড় হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব।বছরে হেক্টর প্রতি দশ থেকে পনেরো টন ভোজ্য তেল পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের সব জায়গা পাম চাষের জন্য উপযোগী।তবে বাংলাদেশ বছরে তার চাহিদার বাইশ ভাগের
ভেতরে মাত্র একভাগ পূরণ করতে সক্ষম।বাকি একুশ ভাগ তেলের চাহিদা বাইরের দেশ থেকে আমদানি করে পূরণ করা হয়।
জানা যায়,প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আফ্রিকায় সর্বপ্রথম
পাম গাছের সন্ধান মিলে।উনিশ শতকের শুরুর দিকে তৎকালীন মালয়েশিয়ার দেশটির সরকার তাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে শোভাবর্ধন উদ্ভিদ হিসেবে পাম গাছের চারা রোপণ করেন আফ্রিকা থেকে এনে।তারপর উনিশশো সতেরো সালে মালয়েশিয়ানরা প্রথমবারের মতো এই পাম চাষ করা শুরু করেন।বর্তমানে এই পাম চাষশিল্পে মালয়েশিয়ায় প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক কাজ করছে।যার ফলে প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও করছে।
যদিও পাম তেলের জন্য সবার শীর্ষে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া।তাছাড়া আমাদের পুরো পৃথিবীর প্রায় শতকরা ৮৪ভাগ পাম তেল সরবরাহ করে আসছে এই মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
পাম ফল থেকে তেল পাওয়া যায়।সে তেল পাম অয়েল নামেই পরিচিত।এটি একটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ।
পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতের প্রায় ২৬০০প্রজাতির পাম গাছ দেখা যায়।পাম ফল থেকে পাম তেল নিষ্কাশন করা হয়।আর পাম গাছের পাতা জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।পাম গাছের একদম শুকনো পাতা মাটিতে ৭.৫ কেজি নাইট্রোজেন,২.৭৯
কেজি ম্যাগনেসিয়াম,৯.৮১কেজি পটাশিয়াম,১.০৬ কেজি
ফসফরাস ফিরিয়ে দেয়। এজন্য বলা যায়,পাম গাছ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত উপকারী।একটা চার পাঁচ বছর বয়সী পাম গাছ থেকে বছরে প্রায় চল্লিশ কেজি পাম অয়েল
পাওয়া যায়। একটা পাম গাছ থেকে একটানা পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর পযর্ন্ত তেল পাওয়া যায়।পাকা পাম ফল সংগ্রহ করে,জলে সিদ্ধ করে দেশীয় পদ্ধতিতে পাম অয়েল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।পাম ফলের বিভিন্ন উপকারী দিক রয়েছে।
এবার পাম ফলের ভেষজ দিকগুলো জেনে নিই।
১. পাম ফল থেকে যে তেল পাওয়া যায় তা কোলেস্টেরলমুক্ত ভোজ্য তেল।এই তেল ব্যবহারে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় না। ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়।আর উপকারী এইচডিএল
কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
২. পাম তেল ধমনীতে প্লাক গঠনে সাহায্য করেনা।ফলে রক্তে জমাট বাঁধার প্রবণতা হ্রাস করে পাম অয়েল।যার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
৩. ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে পাম অয়েল।
৪. ত্বক ওচুলের জন্য বেশ উপকারী তেল এটি।তাছাড়া পাম
অয়েল হজমশক্তি বাড়িয়ে হজমে সাহায্য করে।
৫. এটি শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ তেল।
৬. পাম তেল দৃষ্টিশক্তিকে উন্নত করে।
৭. মস্তিষ্ককে দ্রুত কাজ করতে সাহায্য করে।
৮. শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি পূরণে বেশ কার্যকর।
☆☆পাম গাছ থেকে পাম তেল তৈরির পদ্ধতি
বছরে একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ থেকে প্রায় একশো কেজি পাম ফল পাওয়া যায়।যা কিনা বড়ো হবার পর থেকে বিভিন্ন সময় গাছ থেকে তুলে চাষিরা ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যায়।যেহেতু পাম গাছ বেশ খানিকটা উঁচু আকৃতির হয়,তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে
চাষিরা ফলগুলোকে পাড়ার জন্য নিচ থেকে ধাতুর তৈরী ধারালো একটি বস্তু ব্যবহার করে থাকে।যার মাধ্যমে পাম ফলগুলোকে কেটে সেগুলোকে একত্রিত করে।তারপর সব ফল ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হয়।ফ্যাক্টরিতে পচা বা নষ্ট ফল
গুলো বাছাই করে ফেলে দেওয়া হয়।অতঃপর বাছাই শেষ হলে ফলগুলোকে একটা রোলারের ভেতরে ঢুকিয়ে বিশালাকারের ধারালো ব্লেডের সাহায্যে কেটে ছোট ছোট টুকরা করা হয়।
এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে,পামফলের
ছোবড়া হচ্ছে পাম তেল তৈরির প্রধান কাঁচামাল।এছাড়া সে ফলের ভেতরে যে বীজ থাকে,তার থেকে তৈরী করা হয় পাম
কার্নেল অয়েল,পাম সাবান,পাম ফেসওয়াশসহ আরো বিভিন্ন
জিনিস।
পাম তেল তৈরীতে ফলের খোসাগুলোর উপর তাপ এবং চাপ প্রয়োগ করে সেগুলোকে পিষে তার থেকে পাম তেলকে নিষ্কাশন করা হয়।এই পদ্ধতিকে অনেকটা ঘানি ভাঙ্গা
সরিষার তেলের সঙ্গে তুলনা করা যায়।এই পর্যায়ে পাম ফলের খোসাগুলো থেকে যে তেল বেরিয়ে আসে তাকে বলা হয় Palm crude oil।এবার সেই তেলগুলোকে আবারো রিফাইন করার জন্য প্রস্তুত করা হয়।রিফাইন শেষে তেলগুলোকে ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা হয় তেলের গুণগতমান ঠিক রয়েছে কিনা।সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সে তেলগুলোকে বোতলে করে কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে যখন পাম ফলগুলোকে চাপ প্রয়োগ করে তেল বের করা হয়,তখন
সে ফলের ছোবড়া ও সেখানে থাকা বিচিগুলোকে আলাদা করে,সেই বিচিগুলোকে রিফাইন করার মাধ্যমে পাম কার্নেল
অয়েল প্রস্তুত করা হয়।
এছাড়াও এই বিচিগুলো দিয়ে বিভিন্ন বস্তু তৈরী করা যায়।সর্বশেষ পাম ফলের ছোবড়াগুলোকে, পাম গাছের সারসহ জ্বালানি কাজেও ব্যবহার করা যায়।
১০০ গ্রাম পাম ফল ও তেলের মধ্যে যে পরিমাণে খাদ্য উপাদান মজুদ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে -
পানি- পাম ফলে রয়েছে ২৬ শতাংশ আর পাম তেলে ০.৫ শতাংশ।
ক্যালরি-পাম ফলে ৫৪০ আর পাম তেলে ৮৭৮
আমিষ-পাম ফলে ১.৯% আর পাম তেলে ০%
ফ্যাট-পাম ফলে ৫৮.৪% আর পাম তেলে ৯৯.১%
কার্বোহাইড্রেট-পাম ফলে ১২.৫% আর পাম তেলে ০.৪%
ফাইবার-পাম ফলে ৩.২% আর পাম তেলে ০%
ক্যালসিয়াম-পাম ফলে ১০.৩% আর পাম তেলে ০.৯%
ফসফরাস -পাম ফলে ৫.৯% আর পাম তেলে ১%
লৌহ-পাম ফলে ৪.৫% আর পাম তেলে ৫৫%
সোডিয়াম -পাম ফলে ২.৪%
পটাশিয়াম -পাম ফলে ৫.৩%
ভিটামিন এ-পাম ফলে ৩.৫% আর পাম তেলে ২.৩%
থায়ামিন বি-১-পাম ফলে ১৩.৩% আর পাম তেলে ২%
রাইবোফ্লেভিন বি-২-পাম ফলে ৫.৬%
নিয়াসিন-পাম ফলে ৭%
ভিটামিন সি-পাম ফলে ২৬.৭%
0 Comments