চালতা একটি অপ্রকৃত ফল। এই ফলের যে অংশটি খাওয়া হয়,তা আসলে ফুলের বৃতি। ভক্ষণযোগ্য অংশটা হলো পরিণত বৃত্তির মাংসল পরত।চালতা একটি অবহেলিত ফল হলেও এর রয়েছে নানা খাদ্যগুণ।রূপচর্চাতেও রয়েছে এর দারুণ সব ব্যবহার।বাংলাদেশের সর্বত্র চালতা গাছ জন্মে।
চালতার আদি জন্ম দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়।তবে সব থেকে বেশি জন্মায় ভারত,শ্রীলঙ্কা,চীন,ভিয়েতনাম, ইংল্যান্ড,মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়।চালতা গাছ দেখতে বেশ সুন্দর।উচ্চতা ১৫ মিটার পযর্ন্ত লম্বা হতে পারে।এর গায়ে চকচকে লাল রঙের বাকল থাকে।গাঢ় সবুজ পাতার কিনার থাকে খাঁজকাটা। তাই চালতা গাছ দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হয়। দেখতে সুন্দর বলে চালতা গাছ
শোভাবর্ধক তরু হিসেবে বিভিন্ন পার্ক, উদ্যান এবং বাগানে ও লাগানো হয়। তবে চালতা গাছের মূল আকর্ষণ হলো এর ফুল।এর সাদা রঙের ফুল দেখতে খুবই মনলোভা।ফুল বেশ বড় হয়।প্রায় ৫ ইঞ্চির চেয়ে বেশি।সুগন্ধিযুক্ত এই ফুলে মোট পাঁচটি পাপড়ি থাকে।পাপড়িগুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকে ফুলের বৃতি।ফুলের মাঝে থাকে হলুদ রঙের কেশর।
মে,জুন মাসে চালতা গাছে ফুল ফোটে।চালতা ফল বাঁকানো নলের মত। এতে চটচটে কষ বা রস থাকে।ফলগুলো হয় বড় ও গোলাকার।ফলের রঙ হলুদাভ সবুজ হয়।ফলগুলো টকটক স্বাদযুক্ত হয়।বাংলাদেশের স্থানবিশেষে এই ফল চালিতা বা চাইলতা নামেও পরিচিত।চালতা গ্রামে যতটা সহজলভ্য, শহরে ঠিক ততোটা নয়।কিন্তু চালতার আচার কমবেশি সকলেরই পছন্দের।কিছু কিছু এলাকায় চালতা দিয়ে তরকারি রান্না করা হয়ে থাকে। এছাড়া চালতা দিয়ে চাটনিও তৈরী করা হয়।পাকা চালতা ভর্তা মসলা দিয়ে মাখিয়েও খাওয়া যায়।এই ফলে অন্য অনেক ফলের থেকে পুষ্টিগুণ বেশি।আসুন জেনে নেওয়া যাক চালতার গুণগুলো সম্পর্কে।
১. ক্যান্সার প্রতিরোধে: চালতার মধ্যে আছে বিশেষ ধরণের কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট,যা জরায়ু ও ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
২. রক্ত আমাশয় থেকে : রক্ত আমাশয় হলে চালতা গাছের কচি পাতার রস ২০ মিলিলিটার এক কাপ জলের সাথে মিশিয়ে দিনে দুবার খেলে উপকার পাবেন।
৩. রক্ত পরিষ্কার করতে : উষ্ণ গরম জলে চালতার রস আর অল্প গুড় মিশিয়ে খান, এটি রক্ত পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে।
৪. স্কার্ভি রোগে : ভিটামিন সি এর অভাবজনিত একটি রোগ স্কার্ভি।এই রোগ থেকে সুরক্ষা পেতে চালতা খাওয়া উপকারী।
৫. ঠাণ্ডা লাগা থেকে : গলা ব্যথা,বুকে কফ জমে যাওয়া,সর্দি,কাশি ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধে চালতার আছে অনন্য গুণ।
৬. কিডনি ভালো রাখে: নিয়মিত চালতা খেলে কিডনি ভালো থাকে এবং কিডনির বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
৭. চালতায় থাকা আয়রন রক্তের লোহিত কণিকার কার্যক্রমে সহায়তা করে এবং রক্তের সংবহন ঠিক রাখে।
৮. ডায়রিয়ার সমস্যায় কাঁচা চালতার রস খান উপকার পাবেন।
৯. চালতা ক্যালসিয়াম,ফসফরাস,আয়রন,ভিটামিন এ,বি ও সি এর ভালো উৎস।
১০. চালতায় রয়েছে প্রচুর পরিমানে আঁশ।যা বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
১১. চালতায় উপস্থিত বিভিন্ন উপাদান হার্টের নানারকম রোগ প্রতিরোধ করে।
১২. রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে চালতা।
১৩. চালতায় রয়েছে এন্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান,যা মুখের ভেতরে বাস করা ব্যাকটেরিয়াকে করে ধ্বংস।
১৪. অন্ত্রের সংক্রমন, অর্শরোগ,ডায়রিয়া নিরাময়েও কাজ করে ফলটি।
১৫. বিভিন্ন খাবার থেকে আমরা যে আয়রন পায়, তা আমাদের শরীরে শোষনে সাহায্য করে চালতা।
প্রতি ১০০ গ্রাম চালতায় আছে ১৪০ কিলোক্যালরি শক্তি।যা কাজ করে শক্তিবর্ধক হিসেবে।
শুধু ফল নয়।চালতার মূল ও পাতার রয়েছে নানা ঔষধিগুণ।মচকে গিয়ে ব্যথা পেলে সেখানে চালতার মূল ও পাতা পিষে প্রলেপ দিলে ব্যথা কমে যায়।
রূপচর্চায়ও চালতার ব্যবহার দারুণ কার্যকর।
যেমন- কাঁচা চালতার রস পানিতে মিশিয়ে নিয়মিত চুলের গোড়ায় লাগালে চুলপড়া কমে যায়।কাঁচা চালতার রসের সঙ্গে পেঁয়াজের রস মিশিয়ে সপ্তাহে দুবার চুলের গোড়ায় লাগালেই চুলের খুশকি দূর হয়।চালতার রসের সঙ্গে চালের গুড়া মিশিয়ে স্কাবার হিসেবে ব্যবহার করলে ত্বকের মরাকোষ পরিষ্কারের পাশাপাশি ত্বক হয়ে উঠবে উজ্জ্বল ও কোমল।চালতার রস টোনার হিসেবে ও ব্যবহার করা হয়।চালতার রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে , তাতে তুলো ভিজিয়ে ত্বকে লাগান। দশ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।ত্বকে বলিরেখা পড়া বিলম্বিত করে এই টোনার।চালতার রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে ত্বকের কালো অংশগুলোতে লাগান। আঙ্গুল দিয়ে ম্যাসাজ করুন দশ মিনিট।তারপর ধুয়ে ফেলুন।নিয়মিত ব্যবহারে ত্বকের কালচেভাব দূর হয়ে যাবে।
চালতা দামে সস্তা হলেও তা পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে প্রচুর ক্যালরি,প্রোটিন,খাদ্যআঁশ,ক্যালসিয়াম,ফসফরাস এবং হজম বাড়াতে অ্যাসকরোবিক অ্যাসিড রয়েছে। অন্ত্রে বাসা বাঁধা কৃমির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এ এক অসাধারণ ফল।পাকস্থলীতে যাদের আলসার আছে, তাদের জন্য দাওয়ায় হতে পারে এই চালতা।কানের যেকোন সমস্যায় চালতা ভালো উপকার দেয়।তবে অতিরিক্ত মাত্রায় চালতা খেলে অ্যাসিডিটি হতে পারে।তাই অল্প পরিমাণে নিয়মিত খাওয়া উচিত।তাহলে তা আমাদের রোগ- প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এবং শরীরের যাবতীয় পুষ্টির চাহিদা ও মিটাবে।
x
0 Comments